সপ্ন পূরণের প্রত্যয়
— তিথি নন্দী
শীতের সকাল,চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা। সূর্য উঠলেও তেমন বোঝা যায় না। শীতের সকাল তাই ঘুমও সহজে ভাঙতে চাই না। তবুও শুভ্রকে উঠতেই হবে, কেননা সামনেই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা, তেমন বেশি দেড়ি নেই , এই হবে ছয় বা সাত মাস। স্কুলে যাবার সময় হয়ে আসলো।
ঠিক এমন সময় শুভ্রর বাড়ির দরজায় ঠকঠক শব্দ করে, শুভ্র তখনই বলে উঠল সদু আসলো মনে হয়। শুভ্রর কাছের এবং প্রিয় বন্ধু ছিল সুদর্শন, শুভ্র ভালোবেসে ডাকতো সদু। সুদর্শন ছিল বাপ মা মরা ছেলে,মামা মামির কাছে থাকতো। মামা তাকে ভালোবাসলেও মামির চোখর বালি
ছিল সুদর্শন।
স্কুল যাওয়ার পথে শুভ্র আর সদুর প্রচুর গল্প হতো।গল্পের জন্য তারা বাড়ি থেকে বরাবরই আগে বেরিয়ে পড়তো।তাদের গল্প ছিল বড় হয়ে তারা কি হবে,কেউ কাউকে ভুলে যাবে নাতো। শুভ্র আর সুদর্শন দুই পরিবেশ থেকে বড় হলেও তাদের মনের মিল ছিল একই। স্কুলে সবাই তাদের ভালোবেসে ডাকতো যদু, মধু। সবকিছুতেই মিল থাকলেও মিল ছিলো না পড়ালেখায় শুভ্রর ক্লাসে রোল সাত থাকলে সদুর থাকতো সাতান্ন । পরীক্ষার সময় তারা দুই জন দুই ঘরে বসতো। শুভ্র তার লিখা তাড়াতাড়ি শেষ করে সদুকে জানালা দিয়ে লিখতে সাহায্য করতো। সুদর্শনের পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার কারণ তার মামি। তার মামা চোখ এড়িয়ে সুদর্শনের মামি তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে
নিতো।
এইভাবেই কিছু দিন যাওয়ার পর, সদু যেন আর আগের মতো তাড়াতাড়ি ডাকতে আসে না শুভ্রকে। এই বিষয়ে শুভ্রর মনও খারাপ করে, কিন্তু কিছু সে সুদর্শনকে বলে না।না জানি বললে হয়তো সে দুঃখ পাবে, কারন সে-তো থাকে তার মামা মামির কাছে। শুভ্রর সপ্ন ছিল সে বড় হয়ে একজন বড়ো লেখক হবে এবং তার বন্ধুকে নিয়ে একটা বই লিখবে।অন্যদিকে সুদর্শন সে আার কি সপ্ন দেখবে, কিন্তু তার মামার ইচ্ছা ছিল তাকে ডাক্তার বানানোর। সুদর্শনে পরীক্ষার ফলাফল দেখে তার মামাও আশা ছেরে দিয়েছিল। সুদর্শন ছিল একটু হাসিখুশি প্রাণবন্ত উৎসবমুখর ছেলে। জয়ন্তীর সাথে তার যে কি সম্পর্ক তা সে নিজেও জানে না।
কলোনির পূর্বে শ্যাম কাকার তরিতরকারি দোকান। তার পাশেই ছিল বাড়ি, আসলে বাড়ি না বললেও চলে কারণ খুব অসাস্থ্যকর। বাবার সাথে সব্জি বিক্রি করতো জয়ন্তী, সবাই বলে জন্মের সময় সে তার মা কে খেয়েছে। জয়ন্তীর মুখ ছিল মায়ায় ভরা।কথা গুলো শুনে বেশ ভালো লাগে সুদর্শনের। তাই সুযোগ পেলেই গল্প করতে চলে আসে জয়ন্তীর কাছে।এইভাবে চলতে থাকে।
তারপর একদিন হঠাৎ সদু আর শুভ্রকে ডাকতে আসলো না।শুভ্র অপেক্ষা করে করে স্কুল চলে যায়। পরের দিন আবারও সদু ডাকতে এলো না শুভ্রকে। কয়েকদিন পর শুভ্র সদুর বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় দেখে সদু স্কুলের পোশাক পড়ে কলোনির দিকে যায় জয়ন্তীর সাথে কথা বলার জন্য।
সদুকে কিছু না বলে শুভ্র সদুর মামা কে সব ঘটনা খুলে বলে ।তারপর থেকে সদুর মামা আর তাকে কলোনিতে যেতে দেয় না। এই ঘটনার পর থেকে শুভ্রর সাথেও আর কথা বলে না সুদর্শন। শুভ্রকে হিংসা করতে লাগলো সদু। শুভ্র অনেকবার সদুর সাথে কথা বলতে গেলেও সদু কথা বলেনি।মাধ্যমিক পরীক্ষায় শুভ্রর ফলাফল ভালো হলেও সদুর খুব একটা খারাপ হয়নি।
মামির লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনতে শুনতে সদুর আর অন্যদিকে শুভ্রর সদুর মতো বন্ধু তাকে ভুল বুঝছে এই আক্ষেপ নিয়ে তারা দুজনেই আরো দুইবছর কাটিয়ে দিল।উচ্চমাধ্যমিকেও তারা দুজনেই ফলাফল ভালোই করেছিলো কিন্তু সদুর ফলাফল শুভ্রর চাইতে একটু বেশি ভালো ছিল।
সুদর্শন তার মামার সপ্ন পূরণকরতে সফলও হয়েছিল, সে এখন একজন শহরের নাম করা ডাক্তার। ডাক্তার হলেও আজ ও তার মন থেকে তিন বছর আগের সেই কলোনির মায়াবতী মেয়ে জয়ন্তী যায়নি। সুদর্শনের আজ কোনো বাধা নেই, তাই সে কলোনি গিয়ে জয়ন্তীর খোঁজ করলে, তরিতরকারি বিক্রি করা সেই শ্যাম কাকা বলে তিন বছর আগে জয়ন্তীর বাবা মারা যাওয়ার পর পরিমল বাবু তাকে তার বাড়ি নিয়ে যায়। সুদর্শন সেইমুহুর্তে শুভ্রদের বাড়ি চলে । বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লে পরিমল বাবু মানে শুভ্র র বাবা দরজা খুলে। সদুকে দেখে সবাই অবাক, আজ তিন বছর পর সদু তার প্রিয় বুন্ধু শুভ্রর বাড়িতে। সুদর্শন দেরি না করে বলতে লাগলো —-
—কাকু শুভ্র কোথায়?
— জয়ন্তিকে নিয়ে একটা জায়গায় গেছে।
—- কোথায় গেছে?
—– তোমাদের স্কুলে।
সদু তখনই বেরিয়ে স্কুলে চলে গেল। গিয়ে দেখে একটা মায়াবী মুখ, শাড়ি পড়া একজন নারী শিশুদের ক্লাস নিচ্ছে। সুদর্শন তো জয়ন্তীকে চিনতেই পারেনা। অসাস্থ্যকর পরিবেশের সেই মেয়ে আজ সচ্ছল।
স্কুল মাঠে শুভ্রকে দেখে সদু তার কথা হারিয়ে ফেলে। যেই শুভ্রকে সে ভুল বুঝেছিল সেই আজ তার জন্য এতো কিছু করেছে। শুভ্র সদুকে বলে সেইদিন যদি আমি তোর মামাকে না বলতাম তাহলে কি তুই আজ সপ্ন পূরণ করতে পারতি। সদু লজ্জিত মুখে বলে তুই সত্যিই প্রকৃত বন্ধু।
শুভ্ররও সপ্ন পূরণ হয়েছিল। সে ও একজন নামকরা লেখক হয়েছিল। তার লেখা প্রথম বই ছিল — সুদর্শনের সপ্ন পূরণের প্রত্যয়।